সামাজিক দূরত্ব, অসচেতনতা ও জননিরাপত্তা

করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশজুড়ে যখন এক ধরনের ‘লকডাউন’ চলছে, তখন ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি না মানার কারণে আমরা জননিরাপত্তাকে একটি ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছি। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক ঘটনা ঘটেছে যখন ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি মানা হচ্ছে না।

আমরা দুঃখজনকভাবে লক্ষ করেছি পুলিশ প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও সাধারণ মানুষকে এই ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মাঝে আদৌ কোনো সচেতনতাবোধ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয় না। এটা তো এখন স্পষ্ট যে ইতালিতে যখন প্রথম করোনা ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ল, তখন ‘সামাজিক দূরত্ব’ মেনে না চলায়, তা ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার তাই সামাজিক দূরত্বের বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে। অথচ আমরা কী দেখলাম? আমজনতা যেন এটা বুঝতেই চাচ্ছে না। যেখানে বলা হচ্ছে অহেতুক রাস্তায় না বেরোনো এবং ঘরে বসে থাকার কথা, তখন সেখানে টিভি চ্যানেলগুলো আমাদের জানাচ্ছে কেউ ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি মানছে না।

অতি সম্প্রতি আমরা লক্ষ করলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন ইসলামিক নেতার মৃত্যুতে লক্ষাধিক লোকের উপস্থিতিতে একটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগেও আমরা দেখলাম মানুষ হেঁটে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এসেছিল গার্মেন্টসের কাজে যোগ দিতে। কিন্তু মিডিয়া যখন সরব হল, সরকার যখন কঠোর হল, তখন গার্মেন্ট মালিকরা আবার তাদের বলল ফিরে যেতে।

কী করে গার্মেন্ট মালিকরা এটা চিন্তা করলেন, শত শত কর্মী পাশাপাশি বসে একসঙ্গে কাজ করবে? চিন্তা করা যায় ২১০টি দেশ ও এলাকা আজ করোনা মহামারীতে আক্রান্ত! সামাজিকভাবে যাতে এটা সংক্রমিত হতে না পারে সে জন্যই বলা হচ্ছে Social Distancing বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা। একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞ ডা. করিন ক্রশের (Corinn Cross) উদ্ধৃতি আমি দিতে চাই।

তিনি লিখেছেন, Covid-19 spreads from person to person, reducing the ways people come in close contact with each other is essential. এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা, করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ একজন থেকে আরেকজনের মাঝে ছড়ায়। এর মাধ্যমেই এটা সংক্রমিত হয়। এ জন্যই প্রয়োজন Social distancing বা ‘সামাজিক দূরত্ব’, কম জমায়েত হওয়া, কমপক্ষে ছয় ফুট দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থান করা ইত্যাদি।

ধর্মীয় কুশিক্ষা কিংবা উচ্চশিক্ষা না থাকার কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া রহমানিয়া বেড়তলা মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হয়তো করোনাভাইরাস সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা রাখেন না। কিন্তু ডিসি কিংবা এসপি সাহেবের রাখার কথা। তারা তো জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত।

কিন্তু তারা কী করলেন? কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করলেন না! ওসি স্বীকার করেছেন, তার করার কিছুই ছিল না। অর্থাৎ তার পক্ষে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত (জানাজা) ঠেকানো সম্ভব ছিল না। এ যুক্তি আমরা গ্রহণ করতে পারি না। কেননা সরাইলে ঢোকার সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার সুযোগ ছিল। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী ব্যবহার করা যেত। আমরা সবাই মিলে এটা ঘটতে দিয়েছি।

কিন্তু আমরা এটা বিবেচনায় নিলাম না এক লাখ লোকের উপস্থিতির মাঝে যদি একজনও এ ভাইরাসটি বহন করে থাকেন, তিনি তা ছড়িয়ে দিলেন শত শত মানুষের মাঝে! আর এই শত শত মানুষের মাঝে থেকে এখন সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ল আরও হাজার হাজার মানুষের! এ ভাইরাসটি যে কত ক্ষুদ্র, তা মাইক্রোস্কোপেও দেখা যায় না। ছোট একটি চালের মাঝেও কয়েক লাখ ভাইরাস স্থান করে নিতে পারে।

আমরা এ মুহূর্তে হয়তো বুঝব না আমাদের কী ক্ষতি হয়ে গেল। ১৪ দিন পর আমরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারব যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশপাশের জেলাগুলো থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবর আসতে থাকবে। আমাদের ভয়টা এখানেই। ইতোমধ্যেই গাজীপুর আক্রান্ত হয়েছে।

করোনাভাইরাস সংক্রান্ত ‘সংকটের’ কারণে ‘হোম কোয়ারেন্টিন’ এখন একটা বড় প্রতিষেধক। Business Insider-এর মতে, বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর ৩ ভাগের একভাগ মানুষ এখন ‘লকডাউন’। ভারত, চীন, ফ্রান্স, ইতালি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রেও এখন হাজার হাজার মানুষ ‘হোম কোয়ারেন্টিনে’ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।

এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় বিশ্ব আজ কত বড় সংকটের মধ্যে পড়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে সত্য (৭ কোটি ৫০ লাখ মানুষ), কিন্তু তা এত বেশি দেশকে আক্রান্ত করেনি, যা করোনাভাইরাসে করেছে। বিশ্ব আজ অসহায়।

এ ভাইরাস মোকাবেলায় কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। বিজ্ঞান অসহায়ের মতো লক্ষ করছে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু। এ মৃত্যুর মিছিল কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা আমরা এ মুহূর্তে বলতে পারব না।

বিবিসি আমাদের জানাচ্ছে (২৭ মার্চ ২০২০), ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি আরও দু’মাস দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এর অর্থ পরিষ্কার। আগামী ২ মাস, অর্থাৎ জুন পর্যন্ত আমাদের এ ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি মেনে চলতে হবে। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। প্রচুর মানুষ বড় শহরগুলোয় বসবাস করে। ইতোমধ্যে এটি ‘সামাজিক সংক্রমণে’ পরিণত হয়ে অনেকের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। আইইডিসিআর তাই মনে করে।

ফলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা আমাদের জন্য একটা ‘ওয়েক-আপ’ কল, অর্থাৎ জেগে ওঠার সময়। প্রশাসনকে আরও শক্ত হতে হবে। মানুষ ‘লকডাউন’ মানতে চায় না, ঘরের বাইরে গিয়ে ঘোরাঘুরি করে, পাড়ায়-মহল্লায় আড্ডা দেয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, পুলিশ এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তিনি যে সংক্রমিত হয়ে বাড়ির সবাইকে একটা ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারেন, এটা অনেকেই বোঝেন না। সুতরাং কঠোর অবস্থানে যাওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।

খুদে ব্যবসায়ীর জন্য এটা খারাপ সংবাদ সন্দেহ নেই। কিন্তু মহামারীটি ছড়িয়ে পড়ার আগেই শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। এর বিকল্প নেই। আমরা অনেকে ‘Ripple effect’-এর কথা জানি। Ripple মানে ঢেউ। একটা ছোট্ট ঢেউ সাগরে বা নদীতে যখন তৈরি হয়, তখন তা বিস্তৃত হয়, ছড়িয়ে পড়ে অনেক দূর পর্যন্ত। করোনাভাইরাসটিও Ripple Effect-এর মতো। তা এখন চীন থেকে ছড়িয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র।

আর আমাদের জন্য খারাপ খবর হচ্ছে আমরা জানি না আমার পাশে যিনি আছেন বা আমি যার পাশাপাশি থেকে বাজার করছি, দোকানে যাচ্ছি, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিনা। শুধু সর্দি, কাশি, জ্বর হলেই করোনাভাইরাসে তিনি আক্রান্ত, তেমনটি নয়। বরং গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে এসব উপসর্গ ছাড়াও কেউ করোনাভাইরাসের রোগী হতে পারেন।

আর এ ক্ষেত্রে ওই Ripple effect-এর মতো তিনি ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিতে পারেন শত শত মানুষের মাঝে! এ জন্যই ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরও একটি বিষয়- সরকারপ্রধানের আহ্বান উপেক্ষা করেও কিছু অসাধু ও লোভী গার্মেন্ট মালিক পিপিইর আড়ালে বানাচ্ছে অন্য পণ্য। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন গত ২২ এপ্রিল একটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে।

এজন্য দায়ী করা হচ্ছে বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হককে। এটা ঠিক, বিশ্বজুড়ে পিপিই ও মাস্কের (এন৯৫) একটি চাহিদা তৈরি হয়েছে। সুতরাং গার্মেন্ট মালিকরা এ ধরনের অর্ডার পেতে উৎসাহিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ‘গোপনে’ ফ্যাক্টরি চালু রেখে শ্রমিকদের ডেকে এনে কাজ করিয়ে কত বড় একটা ঝুঁকি তারা সৃষ্টি করলেন, এটা মালিকদের বোঝার কথা।

গার্মেন্ট কর্মীদের জন্য আদৌ কি কোনো সুরক্ষা তৈরি করা হয়েছে? গার্মেন্ট কর্মীদের শুধু মুনাফার লোভে গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। আমার দুঃখ লাগে যখন দেখি একজন গার্মেন্ট কর্মীর মতো তথাকথিত শিক্ষিত মালিকদের মাঝেও সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। তারা বোঝেন শুধু মুনাফা।

মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আমাদের জন্য খারাপ সময় বলে বলা হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে সবাইকে ঘরে থাকতে বাধ্য করা, নিম্ন আয়ের মানুষদের খাদ্যের জোগান দেয়া এবং সেই সঙ্গে ‘সামাজিক দূরত্বের’ বিষয়টি কঠোরভাবে মানতে বাধ্য করা জরুরি।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

tsrahmanbd@yahoo.com